নিউজ প্রাচ্যের ডান্ডি: সদর উপজেলার ফতুল্লাধীন কাশীপুর ইউনিয়নের হোসাইনী নগর এলাকাতে আলোচিত জোড়া খুনের ঘটনায় প্রায় দেড় শতাধিক আসামীর মধ্যে ইতিমধ্যে চুনোপুঁটিরা গ্রেফতার হতে থাকলেও অধঁরা রয়েছেন খুনের নির্দেশদাতাদ্বয় এবং হত্যাকান্ডে জড়িতদের আশ্রয় ও মদদদাতা মহানগর বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুল মজিদ খন্দকার ও তার ভাই শহর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান আহাম্মেদসহ মূলহোতারা।
নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, জোড়া খুনের পর এপর্যন্ত যে কয়েকজন আসামী গ্রেফতার হয়েছে, তারা মূলত চুনোপুঁটি। কিন্তু গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী মাহবুুব হত্যাকান্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে মজিদ ও হাসানের নাম উল্লেখ করে আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয়ার পরেও তাদের গ্রেফতার করতে পারছেন না আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
অথচ, সাম্প্রতিক সময়ে ডিবি পুলিশ বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ঘটনার রহস্য উন্মোচনসহ মূলহোতাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেও জোড়া খুনের অন্যতম নির্দেশদাতা মহানগর বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুল মজিদ খন্দকার দেশে থাকা সত্ত্বেও তাকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন নিহত মিল্টন ও পারভেজের স্বজনেরা।
তবে নিহতদের পরিবারের এহেন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা ডিবি পুলিশের এসআই মো: মাসুদ রানা।
তিনি নিউজ প্রাচ্যের ডান্ডিকে জানান, ‘জোড়া খুনের নির্দেশদাতাদের মধ্যে মজিদ খন্দকারকে গ্রেফতারে আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আর অপরজন তার ভাই এখনো ভারতে অবস্থান করছেন।’
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরেই বাবুরাইল, তাঁতীপাড়া, আমবাগান, বাংলাবাজার, হোসাইনী নগর এলাকাতে জমি ও মাদক ব্যবসার জন্য একটি বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেন বিএনপি নেতা ভ্রাতৃদ্বয় মজিদ খন্দকার ও হাসান আহম্মেদ। আর এই দুই ব্যবসা পরিচালনার আধিপত্য বিস্তার নিয়েই তাদের গ্রুপের সন্ত্রাসী বাপ্পী শিকদার ও মিল্টনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
এই বিরোধের জের ধরে মিল্টন বাহিনী বাপ্পী শিকদারের উপড় হামলা চালায়। তার প্রেক্ষিতে গত ১২ অক্টোবর কাশীপুর হোসাইনী নগর রাজীবের রিক্সার গ্যারেজে বিএনপি নেতা মজিদ খন্দকার বাপ্পী শিকদার বাহিনীর লোকজনদের সাথে নিয়ে এসে মিল্টনের সাথে শালিসী বৈঠক করে। কিন্তু সেই বৈঠকে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে শালিস থেকে মজিদ খন্দকারের সাথে বাপ্পী শিকদারের লোকজন বেরিয়ে যায়। পরবর্তীতে বাপ্পী শিকদারের বস জাহাঙ্গীর বেপারীর নেতৃত্বে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী প্রথমে মিল্টনের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে বাড়ীঘর ভাংচুর করে। পরে রাজীবের রিক্সার গ্যারেজে গিয়ে মিল্টন ও তার সাথে থাকা তারই মাল্টিপারপাস ‘ছায়াবৃত্ত শ্রমজীবি সমবায় সমিতির’ ম্যানেজার পারভেজকে এলোপাথারী কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
এই ঘটনায় নিহতদের পরবিারের পক্ষ থেকে মামলা করা না হলেও পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলাটির অধিক তদন্তের জন্য পুলিশ সুপার তা ডিবিতে বদলী করেন।
মামলার বাদী ফতুল্লা মডেল থানার এস আই মোজাহারুল ইসলাম এজাহারে উল্লেখ করেন, কাশীপুর হোসাইনী নগর এলাকাতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রন, সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রন করে ভূমিদস্যু জাহাঙ্গীর বেপারী। তার গ্রুপের লোক ছিল মিল্টন ও পারভেজ। এর মধ্যে আধিপত্য নিয়ে মিল্টন ও জাহাঙ্গীর বেপারী আলাদা হয়ে যায়। তখন এক গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল জাহাঙ্গীর বেপারী আর অপর গ্রুপের মিল্টন। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চরম আকারে রূপ নেয়। এর জের ধরে গত ৮ অক্টোবর রাত ১১টায় মিল্টনের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর বেপারীর গ্রুপের সদস্য বাপ্পীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপয়ে জখম করে মিল্টন বাহিনী।
ওই ঘটনার জের ধরে গত ১২ অক্টোবর শহরের বাবুরাইল এলাকার জয়নাল আবেদীনের ছেলে জাহাঙ্গীর বেপারী (৪০), ১নং বাবুরাইল তারা মসজিদ এলাকার কাজল মিয়ার ছেলে বাপ্পী (২৮), রবিন (৩০), রকি (২৮), ভূইয়াপাড়া এলাকার মজনু মিয়ার ছেলে আমান (৩২), বাবুরাইল শেষমাথা এলাকার খোকা মিয়ার ছেলে শহিদ (৩০), বাবুরাইল তারা মসজিদ এলাকার আসলাম (৫০), বাবুরাইল ঋষিপাড়া এলাকার মৃত জাকিরের ছেলে মাহাবুব (৩০), বিএনপি নেতা হাসান আহমেদের চাচাতো ভাই শিপলু (৩০) ও ভাগ্নে রাসেল (৩৩), বাবুরাইল এলাকার মুক্তা (২৮), পাইকপাড়া জিমখানা ডিমের দোকান এলাকার শরীফ (৩৩), বাবুরাইলের রানা (২৮), বাবুরাইলের কিরণ (৩০), মানিক (৩০), বাবুরাইলের আবদুল মান্নানের ছেলে ফয়সাল (২৬), বন্দর এলাকার রাব্বি (৩০), ১নং বাবুরাইলের নিলু সরদারের ছেলে সোহাগ (৩২), বাবুরাইল শেষমাথা এলাকার রাকিব (২৭), বাবুরাইল ঋষিপাড়া এলাকার সিরাজ মিয়ার ছেলে রাজন (৩০), বাবুরাইল এলাকার রিক্সা আবুল (৩৫), একই এলাকার ফরহাদ (৫২) সহ অজ্ঞাত আরো ১শ থেকে ১২৫ জন সন্ত্রাসী রামদা, চাপাতি ও লোহার রড নিয়ে মিল্টনের বাড়ীতে হামলা করে। সেখানে তারা বাড়ী ভাংচুর করে সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় রাজীবের মালিকানাধীন রিকশার গ্যারেজে প্রবেশ করে। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা মিল্টন ও পারভেজের উপর হামলা করে তাদেরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে পুপিয়ে জখম করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে তাদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এরপর, জোড়া খুনের ঘটনার পরপরই ইন্ধনদাতা হিসেবে মজিদ খন্দকারের নাম আলোচনায় চলে আসায় তিনি আত্মগোপনে চলে যান। আর তার ভাই হাসান আহাম্মেদ তার স্ত্রী নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র আফসানা আফরোজ বিভার চিকিৎসার অজুহাতে ভারতেই রয়ে যান।
কিন্তু জোড়া খুনের ঘটনায় পুলিশ মামলায় মজিদ খন্দকার ও হাসান আহম্মেদকে সন্দেহের তালিকায় রাখলেও ডিবির হাতে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মাহাবুব গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দিতে জোড়া খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে মজিদ খন্দকার ও হাসান আহম্মেদেও নাম প্রকাশ পায়।
তারপর নিহত মিল্টনের পরিবার সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জোড়া খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে মজিদ খন্দকার ও তার ভাই হাসান আহম্মেদসহ জড়িতদের বিচার ও ফাঁসি দাবী করেন।
এদিকে ডিবি অফিস সূত্রে জানাগেছে, জোড়া খুনের ঘটনায় এপর্যন্ত ১০ জন আসামীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে ডিবি পুলিশ। যার মধ্যে একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন।
আর সর্বশেষ গত ২১ নভেম্বর দিনভর শহরের বাবুরাইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামলার এজাহার ভুক্ত আসামী কিরনসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেন। বাকীরা হলো বাবুরাইল এলাকার বরিশাইল্লা ইমরান, আলাল, জালাল, মনির।